শায়লা জাবীন :
রিদিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে…
জ্বি, আমি রাহাত
মৃদুলা বললো এই ঘরে আসতে…
রিদিতা উঠে দাঁড়ালো, খুবই সরল চেহারার একটা ছেলে, বেশ লম্বা। চেয়ার দেখিয়ে রিদিতা বললো বসুন।
আমি রিদিতা…
জ্বি আমি জানি, কেমন আছেন?
রাহাত বসলো চেয়ারে
রিদিতা বিছানায় বসতে বসতে বললো কীভাবে জানেন?
আপনার বাবা বলেছেন।
আর কি বলেছেন?
আর কিছু না, শুধু বলেছেন আপনি স্বপ্ন দেখে ভয় পান, আর মাঝে মাঝে কিছু স্বপ্ন সত্যি হয়ে যায়।
ওহ, তাহলে তো বাবা সব বলেই দিয়েছেন।
নাহ, সবই বলেননি।
কোনটা বাকি রেখেছেন?
সেটা ঠিক বলতে চাচ্ছি না।
কেন?
কিছু জিনিস বাকি থাকা ভালো, এই যে আমি আজ এসে আপনাকে দেখে জানলাম।
মৃদুলা বেশ শব্দ করে ঘরে ঢুকলো চা আর মোঘলাই পরাটা নিয়ে। টেবিলে নামিয়ে রেখে বললো, রাহাত ভাই এখন চা নাস্তা খান। আর এক ঘণ্টার মধ্যে রাতের খাবার রেডি হয়ে যাবে। মা ইলিশ পোলাও রান্না করছে। সঙ্গে ইলিশ মাছের ডিম ভুনা, কবুতরের মাংস আর জলপাইয়ের আচার।
ঝড় বৃষ্টির দিন ভয়াবহ মজার খাবার, মার রান্না খুবই মজা।
রিদিতা মনে মনে বেশ অবাক হচ্ছে, রাহাতকে আজ সে প্রথম দেখলো। কিন্তু এত পরিচিত মনে হচ্ছে কেন!
মনে হচ্ছে কত দিনের চেনা।
নির্দ্বিধায় তার সব সমস্যা খুলে বলা যায়।
নিশ্চিন্তে এই ছেলের হাত ধরা যায়।
আপা এই নে, তোর চা। এক চামচ চিনি দেওয়া আছে।
তু্ই খাবি না ?
খেয়ে ফেলেছি, বুয়া তো চলে গেছে বিকেলে।
মা সালাদ কেটে দিতে বলেছে, আমি যাই
তোরা গল্প কর…
রাহাত ভাই আপা কিন্তু খুব ভালো গান গাইতে পারে। তবে গাইতে বললে গাইবে না, ইচ্ছে হলে আপন মনে গাই।
বলে হাসি দিয়ে চলে গেলো।
রিদিতা চুপচাপ মৃদুলার যাওয়া দেখলো।
রাহাত বললো, কেমিস্ট্রি পড়তে কেমন লাগছে?
হুম, ভালো…
আমি সাইন্স পছন্দ করি
আপনি কি করেন? পড়াশোনা না চাকরি।
আমি মাত্রই মাস্টার্স শেষ করলাম ফিজিক্সে। দুই মাস হলো একটা চাকরিতে জয়েন করেছি। মা চায় বি.সি.এস. দেই। আমার ইচ্ছে করে না। বাসায় আমি আমার মা আর ছোট একটা ভাই।
বাবা বেশ ক’বছর হলো মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। আপনি খুব বৃষ্টি পছন্দ করেন, তাই না?
কীভাবে বুঝলেন?
প্রায়শই দেখছি জানালার বাইরে আপনার চোখ। খুব মনোযোগ দিয়ে বৃষ্টি দেখছেন। আপনি কি সবসময়েই শাড়ি পড়েন নাকি আজকেই পরলেন?
না, শাড়ি খুবই কম পরা হয়, মা বললো আজ পরতে।
হুম, এজন্যই মনে হয় জড়সড় হয়ে আছেন। কিন্তু আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে এই রঙটায়। মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে শাড়িতে।
রিদিতা মনে মনে চমকে গেলেও খুব স্বাভাবিকভাবে বললো ধন্যবাদ।
আচ্ছা, আজ তাহলে আমি উঠি?
আমার মা আসলেই খুব ভালো রাঁধেন, খেয়ে যান। এই কথার মানে কি ধরে নেব তোমার আমাকে পছন্দ হয়েছে?
সরি, অনুমতি ছাড়া তুমি বলে ফেললাম, তোমাকে আপনি বলতে ইচ্ছে করছে না।
আপনি ড্রইংরুমে বসুন, বাবা অপেক্ষা করছেন। মা খেতে ডাকলে আমি আসবো।
রাহাত রিদিতার দিকে তাকিয়ে ছিল। এই কথা শোনার পর মৃদু হেসে বললো তোমাকে আমি কত খুঁজেছি রিদিতা। তুমি যদি তা জানতে।
আমাকে খুঁজেছেন কেন?
আমিও তোমার মতো অনেক স্বপ্ন দেখি, আর বৃষ্টি ভালোবাসি। বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রাহাত।
অনেকগুলো মোমের আলোতেই রাতের খাবার খাওয়া শুরু হলো, রিদিতা একদমই চুপ ছিল খাওয়ার টেবিলে। কোনো কথা বলেনি, রাহাতও।
রাতের খাবার খেয়েই রাহাত রফিক সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আর কোনো কথা হলো না কারো।
শুধু রোকসানা বলে উঠলেন ছেলেটাকে একটা ছাতা দিলে হতো না, এখনো তো বৃষ্টি পড়ছে। ভিজে যাবে তো।
মৃদুলা বললো মা, একদিন দুইদিন বৃষ্টিতে ভিজলে তেমন কিছু হয় না, আর তোমার বড় মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে এমনিতেই তার অনেক বৃষ্টিতে ভিজতে হবে, তার চেয়ে বরং অভ্যাস হোক, বলেই হাসতে লাগলো।
রিদিতা ঘরে এসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো তখনো বেশ বৃষ্টি, শাড়ি বদলিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। সকালে উঠতে হবে। সঙ্গে সঙ্গেই তার রাহাতের জন্য মন খারাপ হয়ে গেলো, ইসস ছেলেটা একদমই ভিজে বাড়িতে ফিরবে। আচ্ছা চেনা নেই জানা নেই মাত্র দশ পনেরো মিনিট কথা বলে কারো জন্য এত মায়া জন্মে! আশ্চর্য।
মৃদুলা ঘরে ঢুকলো, আপা এইনে তোর মোমবাতি। ইলেকট্রিসিটি কখন আসবে কে জানে। আচ্ছা আপা এটা কি তোর জীবনের প্রথম ডেট ছিল?
নিজের ঘরেই ডেট করলি তাও আবার মোমের আলোতে। কি কপাল তোর!
মৃদুলা, কাল কিন্তু কলেজে যাবি না, ঝামেলা হতে পারে। আপা, প্রথম ক্লাসটা করে চলে আসবো।
না, বলছি তো যাবি না, পরশু যাস। মানা করছি, শুনিস না কেন?
আচ্ছা যাব না, আমি তোর সঙ্গেই ঘুমাই আজ?
হ্যাঁ, আয়…
তোর চুলে বিলি কেটে দেই, যেমনটা ছোটবেলায় দিতাম।
হ্যাঁ দে, রাহাত ভাইকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে, তোদের দুজনকে খুবই মানাবে। তোর কেমন লেগেছে আপা?
আমারো ভালো লেগেছে, বাবা কে বলিস আমি বিয়ে করতে রাজি। তবে অনার্স শেষ করে।
সত্যি বলছিস আপা?
আমার না খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। এখনই যাই, বলে আসি মা-বাবাকে?
না কাল বলিস, এখন ঘুমা।
ভাবতেই ভালো লাগছে, আমি ছাড়াও তোর একজন কেউ হলো। রাহাত ভাইয়ের মোবাইল নম্বর নিয়ে দেব তোকে, তোরা কথা বলিস।
রিদিতা মৃদুলার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো, সে দেখা যাবে ক্ষণ, এখন বল তু্ই তোর কলেজের ম্যাথ টিচারকে চিরকুটটা দিলি কেন, তোর কি উঁনাকে পছন্দ?
মৃদুলা চমকে উঠলো… আপা তু্ই কি মানুষের মনেও ঢুকতে পারিস?
নাহ, পারি না। এমনিতেই বললাম।
মেয়েরা অতিরিক্ত আবেগে অনেক সময় ভুল মানুষ পছন্দ করে বসে। ক্লাস নাইন টেন থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সময়টা বেশি ভয়ঙ্কর। এরপরে কিন্তু ভুল কম হয়।
আশা করি তু্ই ভুলের বয়স পার করে ফেলেছিস। ভুল আবেগকে প্রশয় দিবি না। বুঝেছিস?
রিদিতা দেখলো মৃদুলার নিঃশ্বাস ভারি। ঘুমিয়ে গেছে।
রিদিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরলো। সাথে সাথেই তার রাহাতের কথা মনে পড়লো।
ছেলেটা কি বাসায় ফিরতে পেরেছে, এখনো বৃষ্টি হচ্ছে।
রাহাতও তার মতো স্বপ্ন দেখে, যেই স্বপ্ন দেখে কিছুই করার থাকে না, শুধুই চোখের জল ঝরে।
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো রিদিতার, সূর্যের কড়া আলো চোখে এসে লাগছে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১১টা বেজে গেছে, তাড়াতাড়ি উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলো রিদিতা।
মা, মৃদুলা কই?
রোকসানা বেশ খুশি মনে জিজ্ঞাসা করলো, রাহাতকে নাকি তোমার পছন্দ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ।
কি যে খুশি হয়েছি মা, তোমার বাবাও খুবই খুশি। খুব ভালো ছেলে।
মৃদুলা কই?
কলেজে গেছে, এখনি আসবে
কেন?
চিৎকার করে উঠলো রিদিতা।
আমি মানা করেছিলাম, তোমাকে আর বাবাকেও তো বলেছিলাম, সাথে সাথে ঘরে দৌড়িয়ে গিয়ে মৃদুলার মোবাইলে ফোন করলো রিদিতা।
ফোন বন্ধ। তার মাথা ঘুরছে, আজকে শনিবার। মা আমাকে ধরো।
রিদিতা বিছানায় মাথাঘুরে পড়ে গেলো।
রোকসানা দৌড়িয়ে মেয়েকে ধরলেন।
রফিক সাহেবকে ফোন দিলেন।
বিকেল ৫ টা বাজে…
মৃদুলা এখনো ফেরেনি, বন্ধু-বান্ধবরা বলেছে মৃদুলা আজ কলেজেই যায়নি!
এখন থানা, পুলিশ, হাসপাতাল সবখানে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
রিদিতা তার বিছানায়, একটু পর পর মৃদুলা বলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে।
বাসার সবার মুখ থমথমে, ঠিক সাড়ে ৫টায় রাহাত এলো, রফিক সাহেব বিকালে ফোন করেছিলেন তাকে।
রোকসানা রাহাতকে দেখে বললো, বাবা অফিস থেকে এসেছো। খাওয়ার টেবিলে আসো। খাও কিছু। কি যে একটা বিপদ হলো, রিদিতা মানা করেছিল, কেন যে সকালে ভুলে গেলাম।
রিদিতা কোথায় খালাম্মা?
ওর ঘরে
আমি একটু যাই, দেখে আসি
যাও, ওর অবস্থাও ভালো না, সারাক্ষণ কান্না করছে।
রিদিতা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে।
রাহাত ঘরে ঢুকে বললো, রিদিতা
রিদিতা মাথা তুলে তাকিয়ে বললো, রাহাত আমি মৃদুলাকে বাঁচাতে পারলাম না, বলেই জোরে কান্না শুরু করলো।
রিদিতাকে দেখে রাহাতের খুবই কষ্ট লাগলো। কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার। কাল কেমন দেখলো, আজ কেমন!
বললো এসব কি বলছো, আটকে গেছে হয়তো কোথাও, ফিরে আসবে।
নাহ, আসবে না। ওকে মেরে ফেলছে ওই স্যার। একটু পর ওর ডেডবডির খবর আসবে।
রাহাত এগিয়ে গিয়ে রিদিতার মাথায় হাত রাখলো। এসব বলে না, এমন কিছুই হবে না। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুমি ঘুমাও। মৃদুলা আসবে।
রিদিতা রাহাতের দু’হাত শক্ত করে ধরে বললো, যা বললাম তা একটু পরেই শুনতে পাবে। ঠিক দুইমাস পর আমাদের বিয়ে হবে।
এর ঠিক এক বছর পর আমাদের একটা মেয়ে হবে, যার নাম আমরা রাখবো মৃদুলা।
মৃদুলা এভাবেই আসবে।
অবাক চোখে রাহাত তাকিয়ে আছে রিদিতার দিকে।
দূর থেকে রোকসানা বেগমের মৃদুলা বলে চিৎকার শোনা গেলো। সূএ: জাগোনিউজ২৪.কম